রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে প্রাইভেটকারের আরোহী শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইদ মামুনকে এলোপাতাড়ি গুলি করেছিল সন্ত্রাসীরা। মগবাজারের পিয়াসী বার থেকে বের হওয়ার পরপরই ওই রাতে ৮ থেকে ৯টি মোটরসাইকেলে সন্ত্রাসীরা মামুনকে অনুসরণ করছিল। কার মাধ্যমে, কীভাবে, কোন কৌশল ব্যবহার করে ২৮ বছর পর জেলখানা থেকে বের হওয়া এক সন্ত্রাসীকে নিশানা করা হলো– এর পেছনের গল্প যেন বলিউড সিনেমার কোনো চিত্রনাট্য। ঘটনার এক দিন আগে ১৭ সেপ্টেম্বর ফাঁদ পেতে হিমেল নামে একজনকে ডেকে নিয়ে জিম্মি করেন কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের শিষ্যরা। হিমেলকে ‘ছেলে’ ডাকতেন মামুন। তাঁকে বিশ্বাসও করতেন এক সময়ের ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ত্রাস মামুন। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা চোখ বেঁধে রেখে হিমেলের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। তাঁর মাথায় পিস্তলও ঠেকিয়ে রাখা হয়। হত্যার ভয় দেখিয়ে হিমেলকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে মামুনের অবস্থান নিশ্চিত করে হামলাকারীরা। ঘটনার দিন তাঁর মাধ্যমে দফায় দফায় মামুনকে ফোন করা হয়েছিল। আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি সূত্রসহ একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সিনেমার চিত্রনাট্য ইমনের হত্যা ছক যেন





একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ইমন গ্রুপের সদস্য পূর্বপরিচিত শামীম ১৭ সেপ্টেম্বর ফোন করে হিমেলকে আজিমপুর এলাকায় আসতে বলেন। তখন হিমেল জানান, তাঁর কাছে টাকা-পয়সা নেই। তখন শামীম মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হিমেলকে ৩২০ টাকা পাঠান। ওইদিন বিকেলে হিমেল আজিমপুর পৌঁছালে তাঁকে লালবাগের নোয়াখালী ফার্মেসির অদূরে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে কৌশলে নিয়ে জিম্মি করা হয়। এর পরই তাঁর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। পরে সেখানে ইমন গ্রুপের ৯ থেকে ১০ জন উপস্থিত হন। তারা হিমেলকে বেদম মারধর করতে থাকেন। দুই পায়ের তলায় পেটাতে শুরু করেন। এর পর সন্ত্রাসীরা নির্দেশ দেন, ‘তাঁর কথা মতো মামুনকে ফোন করতে হবে। কোথায় সে অবস্থান করছে, সেটা তাদের না বললে প্রাণরক্ষা করা যাবে না।’ এর পর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করার ভয় দেখানো হয়েছিল।
এভাবে লালবাগের পরিত্যক্ত ভবনে হিমেলকে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত জিম্মি করে রাখা হয়। সন্ত্রাসীদের নির্দেশ মতো, ১৮ সেপ্টেম্বর মামুনকে ফোন করে দেখা করেন হিমেল। ফোনের এপাশ থেকে জানতে চান– মামুন কোথায় রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব কিনা। উত্তরে মামুন জানান, তিনি ঢাকার বাইরে। সন্ধ্যায় এসে হিমেলের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ১৮ সেপ্টেম্বর দিনে মামুন তাঁর বন্ধু মিঠুকে নিয়ে পৈতৃক জমি বিক্রি করতে নোয়াখালীতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় তারা ঢাকায় ফিরে মগবাজারের পিয়াসী বারে যান। রাত ৯টার দিকে লালবাগ থেকে মোটরসাইকেলে করে ইমন গ্রুপের দুই সন্ত্রাসী লালবাগের বাসা থেকে হিমেলকে নিয়ে মগবাজারের আসেন। পেছনে পেছনে আরও কয়েকটি মোটরসাইকেলে অন্য সহযোগীরা তাদের অনুসরণ করে একই গন্তব্যে আসেন। যে মোটরসাইকেলে হিমেলকে চোখ-মুখ বেঁধে বসানো হয়, সেটিতে চালকসহ তিনজন আরোহী ছিলেন। যাতে কেউ বুঝতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হিমেলের মাথায় হেলমেট পরানো হয়। মাঝখানে বসেছিলেন হিমেল। মোটরসাইকেলের সবার পেছনে বসা সন্ত্রাসী পুরো পথে হিমেলের পিঠে পিস্তল ও ধারালো ছুরি ঠেকিয়ে রাখেন। এক সন্ত্রাসী চলন্ত মোটরসাইকেলে হিমেলের কানের কাছে ফোন ধরে মামুনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
মামুন জানান, তিনি পিয়াসী বারে রয়েছেন। ফোনের ওপাশ থেকে হিমেলের অবস্থান জানতে চান। মামুন প্রশ্নও করেন, ‘তুই কি নাটকে আছিস।’ এর উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেন হিমেল। ‘হ্যাঁ’ বলার অপরাধে চলন্ত মোটরসাইকেলে পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়। অপরাধজগতে ‘নাটকে আছিস’– এক ধরনের সাংকেতিক ভাষা। এর অর্থ হলো– সহযোগী কোনো বিপদে বা প্রতিপক্ষ গ্রুপের ফাঁদে পড়েছেন কিনা। হিমেলের কথাবার্তায় সন্দেহের আলামত পাওয়ায় পরিকল্পনাকারীরা মগবাজারে পৌঁছার আগেই মামুন তাঁর সহযোগীদের নিয়ে সেখান থেকে সটকে পড়েন। ৮ থেকে ৯টি মোটরসাইকেলে ইমন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা মগবাজারে যাওয়ার পর যখন নিশ্চিত হন, বার থেকে নেমে প্রাইভেটকারে তেজগাঁওয়ের সাত রাস্তার দিকে চলে গেছেন মামুন, তখন ইমনের পুরো বহর দ্রুত তেজগাঁওয়ের দিকে আসতে থাকে। বিজি প্রেসের কাছাকাছি এসে যানজটে আটকে পড়া একেকটি প্রাইভেটকারে মামুনকে খুঁজতে থাকেন পরিকল্পনাকারীরা। এক পর্যায়ে দেখে একটি প্রাইভেটকারে মামুন বসে আছেন। তখন চালানো হয় এলোপাতাড়ি গুলি। দ্রুত মামুন গাড়ি থেকে নেমে বিজি প্রেসের পাশের গলির দিকে দৌড়ানো শুরু করেন। এর পর পেছন পেছন দৌড়ে তাঁকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। সন্ত্রাসীদের গুলি রাস্তার উল্টো পাশে গিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায় বিদ্ধ হয়। এর পর হামলাকারীরা হিমেলের চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় মোটরসাইকেলে নিয়ে ঝিগাতলার দিকে চলে যান। রাত আড়াইটা পর্যন্ত অজ্ঞাত কোনো স্থানে তাঁকে আটকে রাখা হয়। পরে রাত ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের সামনের সড়কে মোটরসাইকেলে হিমেলকে নিয়ে ফেলে আসা হয়। মোটরসাইকেল থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় নামানোর সময় তাঁকে থাপ্পড় ও কিলঘুষি মারা হয়েছিল।
আরেকটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মামুনের ওপর হামলার পরিকল্পনায় যারা জড়িত ছিলেন, তারা সীমান্ত হয়ে দেশ ছাড়ার জন্য যশোরের বেনাপোল যান। কার মাধ্যমে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেবেন– এটা আগে থেকে ঠিক করে রাখেন ইমন। জড়িতদের মধ্যে অন্তত চারজন এরই মধ্যে দেশ থেকে পালিয়েছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, মারুফ বিল্লাহ হিমেলের বাসা গেণ্ডারিয়ায়। তিনি দীর্ঘদিন জমি কেনাবেচার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। হিমেলের এক আত্মীয় অনেক দিন একটি মামলায় কারাগারে ছিলেন। ওই আত্মীয় যখন হাজিরা দিতে আসতেন, তখন হিমেলও মাঝে মাঝে আদালতে যেতেন। আদালতে মামলার হাজিরা দিতে যেতেন মামুনও। এভাবেই একদিন ওই আত্মীয়র মাধ্যমে মামুনের সঙ্গে পরিচয় হিমেলের। এক পর্যায়ে হিমেল মামুনকে বাবার মতো দেখতেন। মামুনের সঙ্গে হিমেলের ‘বাপ-বেটা’ সম্পর্কের রসায়ন জানতেন কারাবন্দি ইমন ও তাঁর গ্রুপের লোকজন। সম্প্রতি মামুন যখন জামিনে বের হন, তখনই ইমন ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন। ইমনের ধারণা ছিল, বাইরে গিয়ে নিজে গ্রুপ গোছাতে শুরু করবেন মামুন। এতে কারাবন্দি ইমনের প্রভাব কমে যাবে। এর জের ধরে মামুনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। যদিও নব্বই দশকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাং বাবুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসী তালিকায় নাম ওঠান ইমন। এর পর আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মামুনকে নিয়ে গড়ে তোলেন নতুন বাহিনী। এ বাহিনীর নাম হয় ইমন-মামুন গ্রুপ। চাঁদাবাজি, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তারা। ইমন বিয়ে করেন তাঁর আরেক বন্ধু শীর্ষ সন্ত্রাসী টিটনের বোনকে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, এরই মধ্যে হিমেলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এই মামলায় আসামি করা হচ্ছে কিনা, তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।
ঘটনার সঙ্গে হিমেলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বাঁধন নামে তাঁর এক স্বজনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে তেজগাঁওয়ের এ ঘটনা। হামলায় সরাসরি জড়িতদের নাম-পরিচয় শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে র্যাব।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, হামলার ঘটনায় হিমেলকে আটক করা হয়েছে। তাঁর মাধ্যমেই পরিকল্পনাকারীরা মামুনকে ফোন করান।