৮ নভেম্বর ২০২৫—শুক্রবার সন্ধ্যায় তেহরানের ইনকিলাব চত্বরে শত শত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন প্রায় ২০০০ বছর আগের একটি ঐতিহাসিক ঘটনাচিত্রিত একটি ভাস্কর্যের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন দেখতে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পর্দা সরিয়ে যখন আতশবাজির আলো আকাশে ছড়িয়ে পড়ল, তখন প্রকাশ পেল নাকশ-ই রোস্তম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের প্রাচীন শিলা খোদাইকর্মের অনুকরণে তৈরি একটি বিশাল পাথরের ভাস্কর্য—‘ইরানের সামনে নতজানু রোমান সম্রাট’। এই শিল্পকর্মে দেখা যায়, ইরানের সাসানীয় রাজা প্রথম শাপুর ঘোড়ায় আরোহণ করে বসে আছেন, আর তার সামনে হাঁটু গেড়ে আত্মসমর্পণ করছেন রোমান সম্রাট ভ্যালেরিয়ান। ২৬০ খ্রিস্টাব্দের এডেসার যুদ্ধে রাজা শাপুর নিজ হাতে রোমান সম্রাটকে বন্দি করেছিলেন, যা ইরানের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ভাস্কর্যের পেছনের ফলকে খোদাই করা এক বাক্য যেন সেই গর্বকেই স্মরণ করিয়ে দেয়: ‘তোমরা আবার হাঁটু গেড়ে বসবে’। এডেসার যুদ্ধে শাপুরের ঐতিহাসিক বিজয় ইরান পৃথিবীর প্রাচীনতম অবিচ্ছিন্ন সভ্য রাষ্ট্র, যার ইতিহাস অন্তত চার হাজার বছর পুরোনো। এত দীর্ঘ অস্তিত্বের ফলে, দেশটি ইতিহাসজুড়ে অসংখ্য প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯২–৪৯০ সালে ছিল গ্রীকরা; ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে আরব আক্রমণ; ১২১৯ সালে মঙ্গোলরা। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্য ছিল ইরানের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী, বিশেষ করে সাসানীয় যুগে। তেহরানের এই নতুন ভাস্কর্যটি বিশেষভাবে চিত্রিত করেছে এডেসার যুদ্ধ—২০২৫ সালে এই দৃশ্যকে পুনরায় তুলে ধরার পেছনে রয়েছে বিশেষ অর্থ।
তোমরা আবার হাঁটু গেড়ে বসবে ,ইরানের ঐতিহাসিক বার্তা
খ্রিস্টাব্দ ২৬০ সালে, সাসানীয় ইরানের রাজা প্রথম শাপুর এবং রোমান সম্রাট ভ্যালেরিয়ানের মধ্যে সংঘটিত হয় এক ঐতিহাসিক যুদ্ধ— এডেসার যুদ্ধ। সে সময় রোমান সাম্রাজ্য পূর্বদিকে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছিলেন, আর শাপুর দৃঢ়ভাবে সেই আগ্রাসনের জবাব দেন।

ভ্যালেরিয়ান প্রায় ৭০ হাজার সৈন্য নিয়ে তৎকালীন পারস্যের সীমান্তে আক্রমণ করেন। প্রথমদিকে রোমানরা কিছু অগ্রগতি করলেও, শাপুরের নেতৃত্বে ইরানি সেনারা পরিকল্পিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এডেসা (বর্তমান তুরস্কের উরফা) শহরের উপকণ্ঠে। সেখানে ইরানি বাহিনী রোমান সেনাদের ঘিরে ফেলে ও তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। দুর্ভিক্ষ, রোগব্যাধি ও ক্লান্তিতে রোমান সেনারা দুর্বল হয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত সম্রাট ভ্যালেরিয়ান আত্মসমর্পণে বাধ্য হন এবং রাজা শাপুরের হাতে বন্দি হন, যা রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। কখনো কোনো রোমান সম্রাট জীবিত অবস্থায় শত্রুর হাতে বন্দি হননি। এই ঘটনাকে রোমের জন্য এক অভূতপূর্ব অপমান এবং ইরানের জন্য এক অনন্য বিজয় হিসেবে ধরা হয়।
ইতিহাস শুধু যুদ্ধ নয়, প্রতিরোধের প্রতীক
তেহরানের তারবিয়াত মুদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সোরুর খোরাশাদি বলেন, “আমাদের বুঝতে হবে এই ঘটনার বিশালতা। শাপুর শুধু একটি রোমান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেননি; তিনি নিজেই রোমান সম্রাট এবং তার উচ্চপদস্থ সেনানায়ক ও সিনেটরদের বন্দি করেছিলেন। রোমের জন্য এটি ছিল এক নজিরবিহীন অপমান, আর ইরানের জন্য এক তুলনাহীন গৌরব। শাপুর এই ঐতিহাসিক বিজয়কে স্থায়ী করার নির্দেশ দিয়েছিলেন—শিলালিপি ছিল তার উত্তর, আর এখন এই ভাস্কর্য সেই স্মৃতির আধুনিক রূপ।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এটি কেবল একটি যুদ্ধ নয়—বরং পূর্ব ও পশ্চিমের দীর্ঘ ঐতিহাসিক সংঘাতের এক প্রতীকী অধ্যায়, যা হেরোডোটাসের সময়কার পারসিক-গ্রীক যুদ্ধ থেকেই প্রবাহিত হয়েছে।“
ড. খোরাশাদি ব্যাখ্যা করে বলেন, “রোমানদের বিশ্বদৃষ্টিতে পূর্ব ছিল এক ‘অসভ্য' অঞ্চল, যাকে তারা ‘সভ্যতা’ শেখানোর দাবি করত। ‘বর্বর’ শব্দটি ছিল আধিপত্যের ন্যায্যতা দেখানোর অস্ত্র। তাই যখন শাপুর গর্বিত রোমান সম্রাটকে হাঁটু গেড়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করলেন, সেটি শুধু রাজা-রাজা পরাজিত হওয়া নয়—বরং এটি ছিল পূর্বের দৃঢ়তার সামনে পশ্চিমের অহংকারের পতন।”
ইতিহাসের প্রতীক, বর্তমানের অনুপ্রেরণা
তেহরান সিটি কর্পোরেশনের নগরসেবা বিভাগের উপপ্রধান দাউদ গুদারজি জানান, “এই ভাস্কর্যটি শুধু ইতিহাসের পুনরুজ্জীবন নয়, বরং ইরানি জাতির অটলতা, প্রতিরোধ ও মর্যাদার প্রতীক। ভ্যালেরিয়ানের আত্মসমর্পণ ছিল সেই মুহূর্ত, যখন পূর্বের দৃঢ়তা পশ্চিমের অহংকারকে নতজানু করেছিল।”
তিনি বলেন, “ইসরায়েল-আমেরিকার সঙ্গে সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের প্রতিরোধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনির বক্তব্যে যেভাবে দেশের গৌরবময় ইতিহাস ও শত্রুদের পরাজয়ের কথা তুলে ধরা হয়েছে, সেই অনুপ্রেরণাতেই এই ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছে।”
গুদারজি জানান, ভাস্কর্যটি আপাতত ইসলামী বিপ্লব স্কোয়ারে প্রদর্শিত হবে। পরবর্তীতে এটি তেহরানের এমন এক প্রবেশদ্বারে স্থানান্তরিত করা হবে, যা বিদেশি কূটনীতিক ও পর্যটকদের দৃষ্টিগোচর হবে, যাতে তারা শহরে প্রবেশ করেই ইরানের আত্মমর্যাদার এই প্রতীকটি দেখতে পান।
তিনি বলেন, “আমরা চাই শহরের প্রতিটি স্থাপনা শুধু স্থান পূরণের বস্তু না হয়ে সাংস্কৃতিক অর্থবোধ জাগিয়ে তুলুক। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা জাতীয় আত্মমর্যাদা, ঐক্য ও ইরানি পরিচয়ের চেতনাকে শহরের প্রাণে প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”
ইতিহাসের ধারাবাহিক গৌরব
ভাস্কর্যটির পাশেই ইরানের অন্যান্য বীরত্বগাঁথা প্রদর্শিত হয়েছে, বীর আলি দেলওয়ারির নেতৃত্বে ইংরেজদের পরাজয়, মির্জা কুচাক খানের নেতৃত্বে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, রোমানদের বিরুদ্ধে সুরেনার বীরত্ব এবং ডাচদের বিরুদ্ধে মির মুহান্নার সংগ্রাম—যা ইরানি জাতির শতাব্দীজুড়ে চলা প্রতিরোধের ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলেছে।
ইরানের অবিচল আত্মার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি
ভাস্কর্যটির নকশা ও নির্মাণ করেছেন খ্যাতনামা ইরানি শিল্পী পেইমান গানেম। তিনি প্রাচীন ঐতিহাসিক উপাদানকে আধুনিক শিল্পভাষায় রূপ দিয়ে এই ভাস্কর্যকে তৈরি করেছেন যেন এটি শুধু একটি স্মারক নয়, বরং ইরানের অবিচল আত্মার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
নাগরিকদের অনুভূতি
উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত নাগরিকদের মুখে ফুটে উঠেছিল গর্ব ও উচ্ছ্বাস। ১৭ বছর বয়সী ছাত্র হামিদ বলেন, “ইতিহাস নিজেকে বারবার পুনরাবৃত্তি করে। হাজার বছর আগে আমরা পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছি, আজও সেই লড়াই চলছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যেমন শাপুর বিজয়ী হয়েছিলেন, তেমনি আমরাও একদিন আবার বিজয়ী হব।”
শিলালিপি থেকে ভাস্কর্য: এক চিরন্তন বার্তা
শাপুর এই সাফল্যকে শুধু সামরিক নয়, বরং সভ্যতার গৌরব হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি নাকশ-এ রোস্তাম ও বিশাপুরে শিলালিপি খোদাই করান, যেখানে তাকে ঘোড়ায় বসে আর ভ্যালেরিয়ানকে হাঁটু গেড়ে আত্মসমর্পণরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে। এই শিলালিপি আজও টিকে আছে— ইরানের ইতিহাসে জাতীয় মর্যাদা ও আত্মসম্মানের প্রতীক হিসেবে। তেহরানের নতুন ভাস্কর্য যেন সেই চিরন্তন বার্তাই পুনরায় স্মরণ করায়—ইরান কখনও নত হয়নি, আর কখনও হবেও না।