আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। পণ্য ওঠাতে-নামাতে চাঁদা দিতে হয়। এর প্রভাব পড়ে পণ্যমূল্যে। রোজার আগে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাতের কারণে পণ্যের দাম বাড়লেও অভিযান চালানো হয় কেবল পাইকারি ও খুচরা বাজারে। এই হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সরকার চাঁদাবাজিতে বাড়ছে পণ্যমূল্য,
রাজধানীর মতিঝিলে বুধবার এফবিসিসিআই ভবনে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এফবিসিসিআই-এর নবনিযুক্ত প্রশাসক আবদুর রহিম খান। উপস্থিত ছিলেন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার সমিতির নেতারা।
আরও ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি।
শ্যামবাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন বলেন, সাধারণ ব্যবসায়ীদের ওপর করপোরেট ব্যবসায়ীরা রাহুর মতো বসে আছে, শোষণ করছে। ৩ টাকার মোড়ক দিয়ে ৪০ টাকা দাম বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও বাজার নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে না। চাঁদাবাজির প্রলয় চলছে। ট্রাক থেকে পণ্য ওঠাতে-নামাতে চাঁদা দিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও চাঁদাবাজদের সঙ্গে ‘দহরম-মহরম’ রয়েছে। এসব বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্যের কারণে পণ্যের মূল্য ২০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে।
কাওরান বাজার কাঁচামাল আড়তদার সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, কৃষিব্যবস্থা ও বাজারব্যবস্থায় কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকার সঠিক সময়ে পেঁয়াজের সংকট অনুভব না করায় ভোক্তার পকেট থেকে ১০০-২০০ কোটি টাকা বেরিয়ে গেল, এর দায় কে নেবে? এখনো আমদানির অনুমতি না দিলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সংকট আরও বাড়বে। মিলগুলো তেলের দাম প্রতি লিটার ৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে, রোজার আগে আরেক দফা দাম বাড়ানো হবে। এটি জনগণের ওপর বড় আঘাত। তিনি আরও বলেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হচ্ছে তৃণমূলে ৩০ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারছে না। হামলা-মামলা দিয়ে তাদের বিতাড়িত করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের নির্ভয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দিলে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারবে।
অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে এক সপ্তাহের মধ্যে পণ্যের দাম কমে যাবে। ব্যাংক ঋণের সুদ কমিয়ে আনার দিকে সরকারকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, বাজার মনিটরিংয়ে সরকার ব্যর্থ। এফবিসিসিআই, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বছরজুড়ে বাজার মনিটরিং করতে হবে।
রুটি-বিস্কুট প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীদের চাপাচাপিতে এনবিআর রোজার পণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়। কিন্তু এমন সময় শুল্ক ছাড় দেয়, যার সুফল সাধারণ রোজাদাররা পান না, মুনাফাখোররা ভোগ করেন। তিনি আরও বলেন, দেশের বাজারে মসলার অভাব নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মসলা আমদানি কমে গেছে। তাহলে এত মসলা আসে কোত্থেকে, তা খতিয়ে দেখা উচিত।
ফ্রেশ ফ্রুটস আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, শুল্কায়ন বাড়ানোয় ১০০ টাকা কেজি খেজুরের ২০০ টাকা শুল্ক দিতে হয়। এই সুযোগে চৌদ্দ গুষ্টিতেই খেজুর আমদানি করেনি-এমন লোকও আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার করেছে। কাস্টমসই ডলার পাচারের পথ খোলা রেখেছে। তিনি আরও বলেন, রোজা উপলক্ষ্যে টিসিবি খেজুর আমদানির টেন্ডার করেছে, যার দাম ৮২৫ ডলার। সেই খেজুর অন্য আমদানিকারকরা আমদানি করলে ২ হাজার ৬০০ ডলারে শুল্কায়ন করা হয়। তাহলে টিসিবি কি আন্ডার ইনভয়েসিং করছে?
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব গোলাম মাওলা বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা পুরোপুরি আমদানিকারকদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়লেই সরকার অভিযান চালায়। এভাবে অভিযান না চালিয়ে সাপ্লাই চেইনে যেখানে সমস্যা, সেখানে অভিযান চালানো উচিত।
চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল হাশেম বলেন, চিনির বাজার পুরোটা নির্ভর করে আমদানিকারকদের ওপর। রোজায় বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়। মিলগুলো বাজারে সাপ্লাই না দিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম বলেন, তেল-চিনি সংকট দেখা দিলে পুরো দায় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপানো হয়। সরকারকেও তেল-চিনি আমদানি করতে হবে।
চিনি আমদানিকারক সমিতির প্রতিনিধি তসলিম শাহরিয়ার বলেন, সাপ্লাই চেইনে সমস্যা না থাকলে রোজায় চিনির দাম বাড়ার আশঙ্কা নেই। তবে শীতকালে কারখানায় গ্যাসের চাপ কমে যায়। সঠিক চাপ না থাকলে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
এফবিসিসিআই-এর প্রশাসক আবদুর রহিম খান বলেন, সরকারের একার পক্ষে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি খাত এবং গণমাধ্যমকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর অভিযানের উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও সুরক্ষা দিতে হবে। কাউকে অযথা হয়রানি করা যেন লক্ষ্য না হয়। এ সময় ব্যবসায়ীদেরও আইনকানুন সঠিকভাবে অনুসরণ করে ব্যবসা করার আহ্বান জানান তিনি।