আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সে মোতাবেক সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতিমূলক কাজ করে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও প্রার্থী মনোয়নসহ প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বহুল প্রত্যাশিত এই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তার অঙ্গীকার মতে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হলে প্রশাসনসহ নির্বাচনসম্পৃক্ত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের দলনিরপেক্ষ আচরণ ও ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। বাস্তবতা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার তার কার্যকালের ১৫ মাসেও প্রশাসন নিরপেক্ষ করতে পারেনি। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তার দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এখন উপদেষ্টাম-লীও নানা ভাগে ও দলে বিভক্ত হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির তরফে উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দলবাজির অভিযোগ এসেছে। কোন কোন উপদেষ্টা কোন কোন দলের হয়ে কাজ করছেন, তার বিভিন্ন তালিকাও প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। দলানুগত উপদেষ্টাদের অবিলম্বে সরিয়ে দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। প্রশাসনের দলবাজ আমলাদের প্রসঙ্গও সামনে এসেছে। এও জানা গেছে, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির পক্ষ থেকে দলবাজ আমলাদের তালিকা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই প্রশাসনকে দল নিরপেক্ষ করার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে নিরপেক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। কাজটি মোটেই সহজ নয়। গত ১৫ মাসে সরকার পতিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিদায় করতে পারেনি। যদিও সকল মহল থেকে পুনঃ পুনঃ এ দাবি জানানো হয়েছে। কিছু উচ্চপদে রদবদল বা পরিবর্তন হয়েছে বটে, তবে তা যথেষ্ট নয়। এছাড়া বিভিন্ন দলের অনুগত-অনুসারী বলে কিছু কর্মকর্তাকে বদলি ও পদায়ন করা হয়েছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ৭২ জন কর্মকর্তা বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের মধ্যে পতিত সৈরাচারের অনুগত সচিবের সংখ্যা ৩৪ জন। জামায়াতপন্থী কর্মকর্তা ২৯ জন। আর বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা ৫ জন এবং সুবিধাভোগী কর্মকর্তা ১০ জন। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশই বিভিন্ন দলের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন। এনসিপিসহ কয়েকটি দল অভিযোগ করেছে, কর্মকর্তাদের অনেকে বিএনপি ও জামায়াতের হয়ে কাজ করছেন। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা পতিত স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী এবং চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের চুক্তি বাতিল করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব নিয়োগ দেয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। তার এ নির্দেশ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হলে আশা করা যায়, প্রশাসন দলনিরপেক্ষ আদল লাভ করবে। বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা গ্রহণের তাকিদ দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দায়িত্ব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এই সঙ্গে সরকারের চলতি দায়িত্ব পালন। বলা বাহুল্য, উপদেষ্টাদের দলীয় আনুগত্য, প্রশাসনে দলবাজ আমলাদের অবস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার প্রেক্ষিতে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানায়। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের তরফে জামায়াতপন্থী উপদেষ্টা এবং আমলাদের নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে। প্রশাসনে জামায়াতপন্থী সচিবদের সংখ্যা থেকে বুঝা যায়, তাদের দাপট কতটা বিস্তৃত হতে পারে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় জামায়াতের প্রভাব বলতে গেলে নিরংকুশ। বর্তমান মন্ত্রী পরিষদ সচিব শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালনের সময় গোটা শিক্ষাখাতকে জামায়াতের লোকদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা শিক্ষা প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে জামায়াতপন্থী লোকদের বসানো হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বদল হলেও এখনো জামায়তপন্থীরা স্ব স্ব পদে ও অবস্থানে বহাল রয়েছেন। শিক্ষা উপদেষ্টার এ ব্যাপারে করার কিছুই নেই। করার ছিল প্রধান উপদেষ্টার। তিনি করেননি। দেশের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন ১৪ লাখের বেশি শিক্ষক। নির্বাচনে তারা নানান পদে পোলিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, প্রিজাডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জামায়াতের নিয়ন্ত্রণভুক্ত থাকায় তারা জামায়াতের পক্ষে ভূমিকা রাখতে পারেন এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিষয়টি সরকারের গুরুত্ব সহকারে আমলে নিতে হবে।
নিরপেক্ষ করতে হবে প্রশাসনকে
ক’দিন আগে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে স্বৈরাচারের আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের আগামী সংসদ নির্বাচনে না রাখতে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা অনুরোধ জানান। তারা ৩৬ দফার একটা প্রস্তাবনামা সিইসির কাছে হস্তান্তর করেন, ওই প্রস্তাবাবলীর একটিতে বলা হয়েছে ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান জামায়াতে ইসলামীর দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় শতভাগ কর্মকর্তা ও পদাধিকারী জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত। তারা নির্বাচনী দায়িত্বে গেলে দলের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। যা হোক, যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের নৈতিকভাবে ও বাস্তবিকভাবে দলনিরপেক্ষ অবস্থানে অনড় থাকতে হবে। এটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত। যাদের ক্ষেত্রে দলবাজি করার সন্দেহ বা আশংকা আছে, তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়াই উত্তম। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, নির্বাচনের যাবতীয় আয়োজন ও দায়িত্ব পালন করে নির্বাচন কমিশন। সরকার তার কাজে সহযোগিতা করে মাত্র। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব তেমন কোনো লোকবল নেই। এত বড় নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষমতা তার নেই। প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লোকবল দিয়ে তাকে সহায়তা করে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ, সশন্ত্র বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী। মূল দায়িত্ব যেহেতু প্রশাসন পালন করে, সুতরাং প্রশাসনকে দল নিরপেক্ষ করতেই হবে। সরকারকেই দলনিরপেক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য যা করা দরকার, নির্দ্বিধায়, দৃঢ়তার সঙ্গে তা করতে হবে।